সম্প্রতি গত ১১ আগস্ট মহামান্য শীর্ষ আদালত রায় দিয়েছিল, দিল্লি শহরের পথকে আট সপ্তাহের মধ্যে পথকুকুর মুক্ত করতে করতে হবে। পথকুকুরদের আশ্রয়ে আটকে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের খাবার দিতে হবে। দেখভালের জন্য কর্মী,চিকিৎসক নিয়োগ করতে হবে।
মহামান্য শীর্ষ আদালতের এই রায় পশুপ্রেমী ও সাধারণ মানুষেকে মর্মাহত করে। পশুপ্রেমীদের মতে পৃথিবীতে প্রতিটি প্রাণীর স্বাধীন স্বাভাবিক ভাবে সসম্মানে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। পথকুকুর কখনোই বন্যপ্রাণী নয়। তাদের মানুষের সঙ্গে দীর্ঘ বসবাসের ইতিহাস আছে। কোনো অবস্থাতেই তাদের স্বাভাবিক জীবনের অধিকারকে অস্বীকার করে বন্দী জীবনযাপন করতে বাধ্য করা যায় না। তা চূড়ান্ত অমানবিক ও অনৈতিক।
দ্বিতীয় যুক্তি ছিল , সত্যিই বৃহত্তর দিল্লির প্রায়-দশ লাখ কুকুরের জন্য যোগ্য আশ্রয়স্থল তৈরি করা, তাদের খাবার, জল ও চিকিৎসার ন্যূনতম ব্যবস্থাটুকু করা ও তার জন্য প্রাথমিকভাবে যে বিপুল খরচ হবে এবং ধারাবাহিক ব্যবস্থাপনা চালানোর জন্য যে খরচ সেও তো বিপুল অঙ্কের টাকা। সে টাকা যোগাবে কে?
এমনকী, এই বিপুল অর্থ খরচ করা উচিত কি না, সেটাও ছিল একটা ন্যায্য প্রশ্ন।
আশংকা তৈরি হয়, হয়তো কিছুই হবে না আসলে, কিন্তু যেটা হবে তা হল কুকুরগুলোকে ধরে ধরে পুরে দেওয়া হবে কদর্যতম কোনো ঘেটোয়। সেখানে ন্যূনতম খাবার, জল এবং চিকিৎসার অভাবে সবাই গাদাগাদি করে মরে যাবে একে একে।
কিন্তু তাহলেও কি সমস্যা সমাধান হবে? কোনো বড়ো অঞ্চল যখনই কুকুর-শূন্য হয়ে যায়, পাশের নানা অঞ্চল থেকে কুকুররা এসে সেখানে থাকতে এবং বংশবৃদ্ধি করতে শুরু করে। বহু হাজার বছর ধরে কুকুররা এভাবেই বেঁচে এসেছে। দিল্লির সব কুকুরকে মেরে ফেললেও বছর কয়েকের মধ্যে তার সংখ্যা ফের ওই দশ লক্ষে পৌঁছে যাবে। তখন আবার দশ লক্ষ নিধন? তা যদি না হয়,তাহলে বাড়বে ইঁদুরের সংখ্যা, ছড়াবে প্লেগের মতো ব্যাধি। যা মহামারীর রূপ নেওয়ার সম্ভাবনাও প্রবল।
ফলে দেশজুড়ে পশুপ্রেমী ও সাধারণ মানুষ পথে নামেন। আবেদন নিবেদন প্রতিবাদ করেন। ওঠে সমালোচনার ঝড়ও। বহু সেলিব্রিটিও পথ কুকুরদের পাশে দাঁড়ান। শ্রীরামপুরের পশুপ্রেমী সংগঠন আশ্রয় হোম এন্ড হসপিটাল ফর এ্যানিম্যাল ওয়েলফেয়ার এ্যাসোসিয়েশনও পথে নামে। হয় বিশাল পদযাত্রা।
পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি, রায় খতিয়ে দেখার আশ্বাস দেন। তিন সদস্যের বেঞ্চে মামলা যায়।
অবশেষে ২২ আগস্ট সুপ্রিম কোর্ট আগের রায় বদলে নতুন রায়ে বলে, পথকুকুরদের বিজ্ঞান সম্মত উপায়ে কৃমিমুক্ত করতে হবে, টিকাকরণ করতে হবে ও নিবীর্যকরণ করতে হবে, তারপর আবার তার বাসস্থানে ফিরিয়ে দিতে হবে।
পাশাপাশি আদালত এও জানিয়েছে, কোনও শর্তেই রাস্তায় প্রকাশ্যে পথকুকুরদের খাওয়ানো যাবে না। পরিবর্তে প্রশাসনকেই খাওয়ানোর দায়িত্ব নিতে হবে। দিল্লি এবং আশপাশের এলাকায় পুরসভা ধরে ধরে কুকুরদের খাওয়ানোর স্থান নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। এর পরেও যাঁরা রাস্তায় খাবার দেবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ করা হতে পারে। এ নিয়ে অভিযোগ জানানোর জন্য হেল্পলাইন নম্বরও চালু করা হবে। কোনও পশুপ্রেমী যদি রাস্তার কোনও কুকুরকে পোষ্য হিসাবে গ্রহণ করতে চান, দিল্লি পুরসভায় তার জন্য আবেদন জানানো যাবে।
সুপ্রিম কোর্টের রায়কে মান্যতা দিয়ে, স্বাগত জানিয়ে আশ্রয় হোম এন্ড হসপিটাল ফর অ্যানিম্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক বলেন, আমরা এই রায়কে স্বাগত জানাচ্ছি। পাশাপাশি সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি রায়ের পুরো মান্যতা দিয়ে তা কার্যকর করার। অবিলম্বে সমস্ত পরিকাঠামো গঠন করতে হবে। তবে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, যতক্ষণ সরকার পুরো পরিকাঠামো গড়ে না তুলছে ততক্ষণ কি হবে? পথ কুকুরদের আচমকা খাওয়া বন্ধ করলে তো তারা হিংস্র হয়ে উঠবে!
আশ্রয়ের সদস্য রুমী চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, আদালত আগেও এমন রায় দিয়েছে, কোনো সরকারই মানেনি, যেটুকু ফান্ড কোথাও কোথাও অ্যালটেড হয়েছে তার সদ্ব্যবহার হয়নি। কিন্তু পদ্ধতিটা হল, স্বীকৃত একটা ব্যবস্থা - স্টেরিলাইজেশন, ভ্যাক্সিনেশন, মুক্তি।
আশ্রয়ের অপর সদস্য মাবুদ আলি বলেন, আমরা জেলার সব পুরসভা ও পঞ্চায়েতকে চিঠি দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে কার্যকর করার দাবি তুলব। জনাই সংকল্প নামক একটি পশুপ্রেমী সংগঠনের পক্ষে পল্লবী দত্ত জানান,
সুপ্রিম কোর্টের রায় কার্যকর করা ও সার্বিক সচেতনতার দাবিতে আশ্রয়ের সহযোগিতায় আগামী ২৩ আগস্ট বিকেলে ডানকুনিতে একটা পদযাত্রা হবে।
শিক্ষিকা সমাপিকা সিংহ রায় বলেন, কুকুর, বেড়াল, কাক, পায়রা, চড়াই এরা মানুষের ইকো-সিস্টেমেরই অংশ। কোথায় যাবে ওরা? সকলে মিলে সকলের জন্য একটা পৃথিবী গড়ার কথা ভাবাটাও তো জরুরি ?